সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর জীবনী (Sandhya Mukhopadhyay Life in Bengali) , সন্ধ্যা মুখার্জি (Sandhya Mukherjee) উচ্চ মাধ্যমিক 2023 রচনা (HS 2023), উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা রচনা
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর জীবনী (Sandhya Mukhopadhyay Life in Bengali)
প্রদত্ত সূত্র ও তথ্য অবলম্বনে একটি প্রবন্ধ রচনা করো :
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
- জন্ম : ৪ অক্টোবর ১৯৩১ কোলকাতা।
- পিতা : নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
- মাতা : হেমপ্রভা দেবী।
- স্বামী : শ্যামল গুপ্ত (১৯২২-২০১০)।
- সন্তান : সৌমী সেনগুপ্ত।
- সংগীত অ্যালবাম : নায়িকা সংবাদ, আয় খুকু আয় আরও অনেক। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে নায়িকার মুখে তাঁর গাওয়া গান। ও মন কখন শুরু কখন যে শেষ, ঘুম ঘুম চাঁদ, এ শুধু গানের দিন, এমন বহু বিখ্যাত গানের সৃষ্টিকর্ত্রী। ‘গীতশ্রী’ উপাধি অর্জন। হিন্দি ও বাংলা উভয় ছবিতেই গান গেয়েছেন। শ্রেষ্ঠ প্লেব্যাক গায়িকা হিসাবে জাতীয় পুরস্কার। শাস্ত্রীয় সংগীতেও মুন্সীয়ানা। ১২ বছর বয়সে রেডিওতে গান করেন।
- বৈশিষ্ট্য : অন্যধারার গলা ছিল গানের। চপল, ছটপটে কিশোরীর মত গলা যেন খেলতো তাঁর।
- মৃত্যু : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ কোলকাতা।
সন্ধ্যা মুখার্জি জীবনী
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
ভূমিকা
সমাজ সংস্কৃতিতে শিল্পী আসেন, শিল্পী যান। কিন্তু সবাই যুগসৃষ্টি করতে পারেন এমনটা নয়।সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সেই উন্নত মার্গের শিল্পী যিনি তাঁর কন্ঠ লাবণ্যে যুগ তৈরি করে গিয়েছেন। স্বভাবতই তাঁর প্রয়াণ যুগাবসানই। ইতিহাস তৈরি হয়ে উঠে নির্দিষ্ট উপাদানের সাপেক্ষেই। সে উপাদান ছিল বলেই সন্ধ্যা সঙ্গীত ইতিহাস। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কালজয়ী। তাঁর অমৃতময় কন্ঠ সুধা ছায়ার মতো মায়ার মতো জড়িয়ে আছে বাঙালির সর্বাঙ্গে। তাই তিনি বাঙালির মূর্ত সরস্বতী। তাঁর গানে সূর্যোদয়- সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করা যায়,তাঁর কন্ঠে শোনা যায় ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’র ডানা ঝাপটানোর শব্দ,তাঁর গায়কিতে স্নাত ‘রাই’ লজ্জায় রেঙে ওঠে। পপ থেকে প্রার্থনা — তাঁর তুলনা তিনিই। বাংলা গানেতিহাসের সুদীর্ঘ যাত্রা পথে তিনি এক প্ৰণম্য মাইলফলক। সন্ধ্যা স্থায়ী এবং সঞ্চারী। তাই তাঁর যুগ বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। তাই তিনি সুরাকাশের স্বয়ংপ্রভ সন্ধ্যাতারা।
জন্ম এবং বংশপরিচয়
জন্ম কলকাতার ঢাকুরিয়ায় ১৯৩১ সালের ৪ঠা অক্টোবর। বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মা হেমপ্রভা মুখোপাধ্যায়। ছয় ভাই বোনের মধ্যে কনিষ্ঠা সন্ধ্যা।
ব্যক্তি জীবন
১৯৬৬ সালে কবি শ্যামল গুপ্তের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন সন্ধ্যা। ২০১০ সালে ক্যান্সার আক্রান্ত শ্যামল গুপ্তের জীবনাবসান হলে নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে গীতশ্রীকে। একমাত্র সন্তান সৌমি মুখোপাধ্যায়।
সঙ্গীত শিক্ষা
মা বাবার কাছে গান শেখার হাতে খড়ি। ছোট বোনটির সুরের প্রতি আকর্ষণ এবং স্বরক্ষেপনের দক্ষতা লক্ষ্য করে দাদা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সন্ধ্যাকে নিয়ে যান সঙ্গীতাচার্য যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে, তালিম নিলেন মাৰ্গ সঙ্গীতের।
শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চায় নিবেদিত প্রাণ সন্ধ্যা প্রশিক্ষণ নিলেন সন্তোষ কুমার বসু, টি এ কানন, চিন্ময় লাহিড়ী প্রমুখের কাছে। সন্ধ্যার জীবনে সুবর্ণ সুর সন্ধীর সংযোগ ঘটালেন পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, তিনি সন্ধ্যাকে উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী গুরু বড়ে গোলাম আলীর কাছে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিলেন। গুরুজীর মৃত্যুর পর তিনি গানের পাঠ অব্যাহত রাখলেন গুরুর পুত্র উস্তাদ মুনাবর আলীর কাছে।
কৃতিত্বের স্বাক্ষর
বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স, অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে নজর কাড়া পারফরম্যান্স। ১৯৪৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাংলা বেসিক গানের রেকর্ড। ১৯৪৬ সালে সন্ধ্যা প্রথম হন ‘গীতশ্রী’ পরীক্ষায়। প্রথম স্থান ভজনেও, পরীক্ষক ছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খান, উস্তাদ দবির খান।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় জীবনী
গান ভুবনের পর্যটক সন্ধ্যা
১৯৫০ সালে সন্ধ্যা পাড়ি দিলেন বোম্বাই, পথ প্রদর্শক শচীন দেব বর্মন। অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘তরানা’ ছবির জন্য প্ৰথম প্লেব্যাক করলেন সন্ধ্যা। ১৯৫২ এ কলকাতায় ফিরে আসার আগেই ১৭ টি হিন্দি ছবিতে গান গাওয়া হয়ে গিয়েছে তাঁর। বোম্বাই ইন্ডাস্ট্রি তাঁর গায়কীর জাদুকরীতে ততদিনে মুগ্ধ বিহ্বলতায় আবিষ্ট শ্রোতা …। নানা রঙের গানে সন্ধ্যার পৃথিবী বিপুল – উচ্চাঙ্গসংগীতের কনসার্ট থেকে রাগপ্রধান গান গেয়েছেন বহু ছবিতে, যেমন ‘উত্তর ফাল্গুনী’- তে তাঁর খাম্বাজ-নিবদ্ধ ‘তেরে নয়না লাগে ‘ । কীর্তনের রস চুইয়ে পড়েছে কমললতা ছবির গানে গানে। ‘সে বিনে আর জানে না’ বাউলাঙ্গ কীর্তন গানে সন্ধ্যা শ্যামল পাগল করে দিলেন শোতৃ কুলকে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গানে যাঁর অবাধ ও সাবলীল বিচরণ তিনিই আবার গেয়েছেন ‘প্রভুজি তুমি দাও দরশন’ এর মতো তুলনাহীন বাংলা ভজন। প্রাচ্যের মার্গদানা হোক বা পাশ্চাত্যের ক্রুনিং, সন্ধ্যা সবেতেই অসাধারণ।
সন্ধ্যার কালজয়ী গানের তালিকা
১৯৪৮ সালে ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে রাইচাঁদ বড়ালের সুরে সেই যে গাওয়া শুরু, তারপর সন্ধ্যাকাশে একে একে ঝকঝকিয়ে উঠল ‘চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কী হবে’, ‘শঙ্খ বাজিয়ে মাকে ঘরে এনছি’,’আমি যে জলসা ঘরে’, ‘এ গানে প্রজাপতি পাখায় পাখায় রং ছড়ায়, ‘কেন ডাকো বারে বারে, ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’,’বকবক বকম বকম পায়র’, ‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’, ‘কে তুমি আমারে ডাকো,’গুপচুপ গুপচুপ পেয়ার ক্যেরে’, বোল পাপিহে বোল’ এর মতো উজ্জ্বল সব নক্ষত্ৰ৷
সন্ধ্যা ও কিংবদন্তি সুর স্রষ্টা মণ্ডলী
সন্ধ্যা কন্ঠে এই সব সুর সুধা ঢেলে যারা সন্ধ্যাকে অদ্বিতীয়া করলেন তাঁদের কথা না বললে তো বোধ হয় সন্ধ্যা বৃত্ত পূর্ণতা পাবে না – এঁরা হলেন শচীন দেব বর্মন, অনিল বাগচি, মদনমোহন, সলীল চৌধুরী, অনুপম ঘটক,নচিকেতা
ঘোষ,রবীন চট্টোপাধ্যায়ের, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়,হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
মুক্তিকামী মানুষের মানবিক সন্ধ্যা
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অখন্ড বাংলার উত্তরাধিকার। পাক কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পাওয়ার স্মরণে সন্ধ্যা গাইলেন ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়।’ এছাড়াও আবিদুর রহমানের লেখা ও সুধীন দাশগুপ্তের সুরারোপিত গান ‘কী ভালো তোমাকে বাসি আমরায়’ ধরা রয়েছে দুই বাংলার অভিন্ন জাতিসত্তার শপথ।
বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে সন্ধ্যা অবতীর্ণ হয়েছিলেন অন্য ভূমিকায়। শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতে গানকে হাতিয়ার করেছিলেন তিনি। সমর দাস ও তাঁর প্রয়াসে কলকাতায় গড়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র৷
সম্মান ও পুরস্কার
প্রবাদপ্রতিম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় জীবনে বহু সম্মান পেয়েছেন। ‘জয়জয়ন্তী’ ও ‘নিশিপদ্ম’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার। পেয়েছেন বঙ্গবিভূষণ সম্মান। প্রত্যাখ্যাণ করেছেন জীবনের শেষ পর্বে পাওয়া ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান।
মহাপ্রয়াণ
১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২২, কলকাতার অ্যাপেলো গ্লেনিগেলস হাসপাতালে সন্ধ্যা ৭ টা ৩০ মিনিটে সন্ধ্যা ‘এই শহর থেকে আরও অনেক দূরে’ গানটি শুনতে শুনতে না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন।
উপসংহার
সাদামাটা-প্রচারবিমুখ-বিনয়ী জীবন। শিল্পের সব শাখার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর অনুসন্ধিৎসু মন অমরত্ব দিয়েছে এই শিল্পীকে। যুগ বদলেছে, যুগের চাহিদা ও। তার সঙ্গে নিজেকে আপাদমস্তক বদলে ফেলার পথে হাঁটেননি তিনি। এই দৃঢ়তা বড়মাপের শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব, যিনি জানেন যা রেখে যাওয়া গেল তা অক্ষয়ধর্মেই চিরস্থায়ী হবে।
লেখনী – গৌরহরি দাস, শিক্ষক।