কাজী নজরুল ইসলাম – প্রবন্ধ রচনা, জীবনী

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর জীবনী (Kazi Nazrul Islam Biography in Bengali) , কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চ মাধ্যমিক 2024 রচনা (HS 2024), উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা রচনা

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম – প্রবন্ধ রচনা (নজরুল ইসলাম জীবনী)

প্রদত্ত সূত্র ও তথ্য অবলম্বনে একটি প্রবন্ধ রচনা করো :

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম

জন্ম : ১৮৯৯ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ। বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মস্থান। 

পিতা : কাজী ফকির আহমেদ। কবির শৈশবেই প্রয়াত। 

মাতা : জাহেদা খাতুন। 

শিক্ষাগত যোগ্যতা : স্কুল স্তর (অসম্পূর্ণ) ছেলেবেলাতেই সেনাবাহিনীতে যোগদান ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। 

সাহিত্য চর্চা : ১৯২০-তে করাচি থেকে ফিরে সাহিত্য চর্চারম্ভ। 

বিভিন্ন সাহিত্য : কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ – ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘ভাঙার গান’, ‘ফণিমনসা’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’ ইত্যাদি। 

কবির সংগীত গ্রন্থ: ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘সুরসাকী’, ‘গানের মালা’, ‘রাঙাজবা’, ‘সন্ধ্যামালতী’ ইত্যাদি। 

জাতীয়তাবাদী চেতনা : ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য কারারুদ্ধ হন। কারাবাসে তার অনশন সরকারকে বিচলিত করেছিল। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি নিষিদ্ধ হয়। বিদ্রোহী তকমা পান। 

মৃত্যু: নজরুল শেষ বয়সে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় দীর্ঘ প্রায় তিন দশক অতিবাহিত করে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হন।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম

আয় চলে আয় রে ধূমকেতু 

আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, 

দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে 

উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন!

রবীন্দ্রনাথ

ভূমিকা : ‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুলের সংগ্রামের হাতিয়ার ছিল তাঁর কবিতাও গান। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা একসময় বাঙালিকে উদ্দীপিত করেছিল। তার বিদ্রোেহ কেবল সেদিনের বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধেই ছিল না, যেখানে যত অবিচার সেখানেই তিনি গানে কবিতায় আঘাত হেনেছেন — সাম্যের গান গেয়েছেন, নারী মুক্তির বন্দনা রচনা করেছেন, ধর্মান্ধতাকে কশাঘাত করেছেন। এই কবিই ফাঁসির মঞ্চে ‘জীবনের জয় গান’ শুনিয়েছেন। আর ছিল তাঁর প্রাণমাতানো উচ্ছল দরাজ কন্ঠের গান। যে আসরে তিনি উপস্থিত থাকতেন, গানে কবিতায় হাসি গল্পে সে আসর জমজমাট হয়ে উঠতো।

জন্ম ও বংশপরিচয় : অবিভক্ত বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে ইংরেজি ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে মে মঙ্গলবার নজরুল জন্মগ্রহণ করেন এক বিত্তহীন সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি।

শিক্ষা ও জীবন জীবীকা : জন্মলগ্ন থেকেই ভাগ্যের নিষ্ঠুর কষাঘাতে জর্জরিত ‘দুখু মিঞা’, শৈশবে পিতৃহীন হয়ে প্রথম থেকেই তাঁকে কঠোর জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। ১০ বছর বয়সে মক্তবে নিম্ন-প্রাথমিক পরীক্ষা পাশ করে ওই মক্তবেই এক বছর পড়ান। বাল্যকালে সাধু সন্ন্যাসী বাউল দরবেশ প্রভৃতির সঙ্গ লাভ করতে ভালবাসতেন কাজী নজরুল। মাত্র ১১ বছর বয়সে ‘লোটো’ নাচের উপযুক্ত কাহিনী ও গান রচনা করে অর্থ উপার্জন করেছেন তিনি। খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের বাবুর্চি হিসেবে কাজ করতে করতে একসময় তিনি আসানসোলের এক রুটির দোকানে পাঁচ টাকা বেতনে কাজ করেন। এই সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ তাঁকে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সিয়ারসোল রাজ হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর কৃতী ছাত্র নাজিরুল দেশপ্রেমের আহ্বানে সৈনিক বৃত্তি নিয়ে ৪৯নং বেঙ্গল রিজিমেন্টে যোগ দিয়ে ১৯১৭-১৯ খ্রি.সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগর ছেড়ে কলকাতায় এসে তিনি ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানিতে কম্পোজার ও ট্রেনার হয়েছিলেন। এই সময়েই তিনি গায়ক-সুরকার-গীতিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এক সময় কৃষ্ণনগরে তাঁর বাসার কাছে তিনি শ্রমজীবী নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

কবি-কথাকার-গীতিকার-সুরকার, গায়ক-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক নজরুল :  নজরুলের কবিতা ও গান সম্বন্ধে রবি ঠাকুর বলেন – 

“অরুগ্ন, বলিষ্ঠ, হিংস্র-নগ্ন বর্বরতার অনবদ্য ভাবমূর্তি রয়েছে কাজীর কবিতায় ও গানে, কৃত্রিমতার ছোঁয়াচ তাকে কোথাও ম্লান করেনি।”

বাঙালির মনে ও মননে রবীন্দ্রনাথের পরেই নজরুলের স্থান। তাঁর লেখনীর স্বাতন্ত্র্য তাঁকে মানুষের খুব কাছের জন করে তুলেছে। 

‘অগ্নিবীণা’, ‘চক্রবাক’, ‘ছায়ানট’, ‘জিঞ্জীর’, ‘ঝড়’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘প্রলয়শিখা’, ‘ফনিমনসা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সঞ্চিতা’, ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যবাদী’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে বিদ্রোহী কবির অন্তরের আগুন প্রতিফলিত হয়েছে। ২২ বছরের তরুণ কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ৬ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ‘বিজলি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে রাতারাতি তিনি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান। এই বছরই ২৮ শে সেপ্টেম্বর ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিস্ফোরক কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। এই কবিতার বিদ্রোহ বাণী সহ্য করতে না পেরে ইংরেজ সরকার তাঁকে এক বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। কারাবাসকালীন জেল কর্তৃপক্ষের নৃশংস ব্যবহারের প্রতিবাদে নজরুল আমরণ অনশন শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ অনশন ভঙ্গের জন্য টেলিগ্রাম পাঠিয়ে লিখলেন 

‘give up hunger strike, our literature claims you.

নজরুল ইসলাম প্রায় চার হাজার গান রচনা করেছেন যার জন্য তিনি কালজয়ী এবং অদ্বিতীয় জনপ্রিয়। আজও তাঁর গান চরম রোমাঞ্চকর এবং উদ্দীপক। এযুগের বিখ্যাত সুরকাররা যখন বানিজ্যিক সাফল্যের জন্য তাঁর গান ঋণ করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তখন তার জ্বলন্ত প্রমাণ পাওয়া যায়।

গায়ক নজরুল সম্বন্ধে মুজফ্ফর আহমেদ বলেছেন – 

‘নজরুলের জনপ্রিয়তার অন্য একটা কারণ ছিল তাঁর গান। অন্যান্য গান গাইলেও সে মূলত রবীন্দ্র সংগীত গাইত। এত বেশি রবীন্দ্রসংগীত সে কিভাবে মুখস্ত করেছিল তা ভেবে আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম। তাঁর গান সব শ্রেণির লোককে আকর্ষণ করত।’

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হাবিলদার নজরুল বাংলাদেশের পত্রিকার জন্য বাংলাদেশের পত্রিকার জন্য গল্প, কবিতা, গান প্রভৃতি লিখে পাঠাতেন। ১৯১৯ খ্রি.’বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়’ তার ‘মুক্তি’ কবিতা প্রথম ছাপা হয়। এই পত্রিকাতে একই সালে তাঁর ‘ব্যথার দান’ ও ‘হেনা’ গল্প দুটি ছাপা হয়। এই গল্প দুটিতে লেখকের দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতা পরিচয় পাওয়া যায়।

ভারতীয় সাংবাদিকতায় নজরুলের স্থানাঙ্ক নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। অথচ কবি পরিচিতির প্রথম লগ্ন থেকেই সাংবাদিক তথা সম্পাদক হিসেবে তাঁর কাজকে রবীন্দ্রনাথ থেকে সরোজিনী নাইডুর মতো অনেকেই মান্যতা দিয়েছিলেন। তিনি ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’ প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এই পত্রিকাগুলির সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রায়শই প্রকাশিত হত ব্রিটিশ শাসকের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের ঘৃণিত রূপ। তাঁর কলম বর্ণবাদের অভিশাপ চিহ্নিত করেছে আবার কখনোবা বাঙালি নারীর নিজস্ব সময় ধরার ধারালো প্রচেষ্টা।

সম্মাননা : কাজী নজরুল ইসলাম ভারত ও বাংলাদেশের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছেন। বাংলাদেশের তিনি জাতীয় কবি। এদেশে চরুলিয়ায় নজরুল চর্চা কেন্দ্র ‘নজরুল একাডেমি’, ২০১২ সালে আসানসোলে স্থাপিত হয়েছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। এ দেশে বহু সড়ক সরণি তাঁরই নামাঙ্কিত। ১৯৪৫ খ্রি. তিনি জগত্তারিণী, ১৯৬০ খ্রি. পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৭৫ খ্রি. শহীদ দিবসে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘একুশে পদক’ দিয়ে সম্মানিত করে। তবে নজরুলের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান বা পুরস্কার বোধহয় রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক নজরুলকে উৎসর্গীকৃত ‘বসন্ত’ নাটক।

প্রয়াণ : ১৯৪২ খ্রি. পক্ষাঘাতে আক্রান্ত কবি বোধশক্তিহীন ও নির্বাক হয়ে যান। শেষে ২৯ শে আগষ্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় কবির জীবন দীপ নির্বাপিত হয়।

উপসংহার : হানাহানি, বিদ্বেষ, শোষন, অপশাসন, সাম্প্রদায়িকতা, মনুষ্যত্বহীনতার পুঁতিগন্ধ আজও এ সমাজে বর্তমান। তাই এখনো আপোষহীন বিদ্রোহী কবি নজরুল সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতো জ্বলন্ত অগ্নি শলাকা প্রতিবাদী মানুষের বুকে চলমান।

রাজনীতির ভাগের চুরি বাংলার ভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারলেও, বাঙালির আত্মাকে করতে পারেনি। সেই কবে এই সারকথা জানিয়ে দিয়েছিলেন কবি অন্নদাশঙ্কর রায় –

‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল

আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে

ভাগ হয়নি কো নজরুল’

Read More :

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর জীবনী

দ্বিশত বর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত – প্রবন্ধ রচনা | মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *