মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর জীবনী (Michael Madhusudan Dutt Biography in Bengali) , দ্বিশত জন্মবর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত উচ্চ মাধ্যমিক 2024 রচনা (HS 2024), উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা রচনা
দ্বিশত বর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত – প্রবন্ধ রচনা (মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনী)
প্রদত্ত সূত্র ও তথ্য অবলম্বনে একটি প্রবন্ধ রচনা করো :
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
- জন্ম: ২৫ জানুয়ারি ১৮২৪, সাগরদাঁড়ি গ্রাম, যশোর (অধুনা বাংলাদেশ)।
- পিতা-মাতার নাম : জাহ্নবী দেবী, রাজনারায়ণ দত্ত।
- শিক্ষাজীবন: হিন্দু কলেজ, বিশপস্ কলেজ, মাদ্রাজ অ্যাসাইলাম স্কুলে শিক্ষকতা, মাদ্রাজ হাইস্কুলে শিক্ষকতা, Spectator পত্রিকার সম্পাদক।
- কবির স্বপ্ন ও লক্ষ্য : হোমার, মিলটনের মতো মহাকবি হওয়া, খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ।
- নাটক রচনা: ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণকুমারী’, ‘একেই কী বলে সভ্যতা’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’।
- কাব্যরচনা: বাংলা কাব্য সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, ‘Captive Ladie’ ও ‘Vision of the past’ – (১৮৪৯), তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য (১৮৬০), মেঘনাদ বধ কাব্য (১৮৬১), ব্রজাঙ্গনা কাব্য (১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৮৬৬)।
- জীবনাবসান: ২৯ জুন ১৮৭৩।
দ্বিশত বর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত – প্রবন্ধ রচনা
জন্ম ও পিতৃ পরিচয়: ১৮২৪ খ্রী. ২৫ শে জানুয়ারি, যশোহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে কবি মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়। পিতা ছিলেন সেকালের সম্ভ্রান্ত ও সজ্জন আইনজীবী রাজনারায়ণ দত্ত। মাতা জাহ্নবী দেবী। ছোটবেলা থেকে কবি মধুসূদন মাতৃস্নেহছায়ায় লালিত হয়ে যত্ন-বিলাসিতার মধ্যে পরিপালিত হয়েছিলেন। ফলে, মধুসূদনের বহিঃসভাব বিলাসী ও উশৃংখল হয়ে উঠেছিল, তেমনি আন্তঃসত্তায় তিনি ছিলেন ধ্যানী ও যোগীর মতো স্থির ও স্বতন্ত্র।
শিক্ষাজীবন: সাত বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। খিদিরপুর স্কুলে দুবছর পড়ার পর ১৮৩৩ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শেখেন। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করায় মধুসূদনকে কলেজ ত্যাগ করতে হয়। তাই ১৮৪৪ সালে তিনি বিশপ্স কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৪৭ পর্যন্ত এখানে অধ্যয়ন করেন। ধর্মান্তরের কারণে মধুসূদন তাঁর আত্মীয়স্বজনদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অগত্যা মধুসূদন ভাগ্যান্বেষণে ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজ গমন করেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। প্রথমে মাদ্রাজ মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কুলে এবং পরে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন।
কাব্যে উন্মেষ: কবি মধুসূদন প্রথম জীবনে ইংরেজি কবিতা রচনায় উৎসাহিত হয়ে ছোট বড় অনেক কবিতা এবং খন্ডকাব্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু এই কাব্যগুলোর মধ্যে কোন মৌলিকতার পরিচয় নেই। মাদ্রাজ থেকে ‘Madras Circulator’ পত্রিকায় কবি মধুসূদন ‘Timothy Penpoem’ ছদ্মনামে ‘A vision of the past Captive of Ladie’ নামে ইংরেজি কাব্যে পৃথ্বীরাজ-সংযুক্তার কাহিনী বর্ণনা করেন। কাব্যটি বাঙালির রচনা হিসেবে খুব প্রশংসা পেয়েছিল। বেথুন সাহেবও কাব্যটি পড়ে মুগ্ধ হন।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি: কাব্য রচনার পূর্বে মধুসূদন ইউরোপীয় কাব্য সাহিত্যের চর্চা করেন এবং কবি মিলটনের ‘Blank Verse’ ছন্দ অবলম্বনে তিনি বাংলা ছন্দে ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ প্রবর্তন করেন। এই অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম প্রয়োগ তিনি ‘তিলোত্তমা সম্ভব’ কাব্যে’ করেন। তিনি মনে করেছিলেন, সেকালের পয়ার ছন্দের ৮ + ৬ যতিবন্ধনের ভাবধারাকে মুক্তি দিতে হলে সর্বপ্রথম পয়ারের ছেদ-যতি বন্ধনের ভাবধারাকে খুলে ফেলে চরণকে ভাবের আবেগে ছেড়ে দিতে হবে।
তিলোত্তমা সম্ভব: এই কাব্যটি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। সংস্কৃত পুরান থেকে কবি এর উপাদান সংগ্রহ করেন। সুন্দ-উপসুন্দ দৈত্য ভ্রাতাদের বধের জন্য তিলোত্তমা অপ্সরার সৃষ্টি কাহিনীকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে কবি মধুসূদন চার সর্গে এই আখ্যান কাব্যটি রচনা করেন। প্রথম প্রয়োগ বলে কিছুটা ত্রুটি থেকে গিয়েছে। তিলোত্তমার ভীরু ও লাজনম্র রোমান্টিক সৌন্দর্য বর্ণনা ইংরেজি কবি কীটসের সৌন্দর্য সৃষ্টির কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
মেঘনাদবধ কাব্য: এরপর বাল্মিকী ‘রামায়ণ’ মহাকাব্যের ‘লঙ্কাকাণ্ডে’র অন্তর্গত ‘মেঘনাদবধ’ অংশ খানি নিয়ে মোট নটি খন্ডে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নামে মহাকাব্যে রচনা করেন। বীর বাহুর নিধন সংবাদ থেকে মেঘনাদের হত্যা এবং প্রমীলার স্বামীর চিতায় আরোহন পর্যন্ত মোট তিন দিন ও দুই রাতের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মূল রামায়ণ থেকে কাহিনী নেওয়া হলেও কবি মধুসূদন রাবন, মেঘনাদ ও প্রমিলাকে অভিনব রূপে এই কাব্যে অঙ্কিত করেছেন। রাবণ যেন নিখিল মানবতার প্রতীক। তিনি দানব নন – তাঁর জীবনটা ট্রাজেডি আমাদের অশ্রু ভারাতুর করে তোলে। কবি মধুসূদনের নারী চরিত্রাঙ্কনে দুইরূপ পরিলক্ষিত হয়। প্রমিলার চরিত্রাঙ্কনে সমুদ্রের প্রবল জলোচ্ছ্বাস আর সীতা-শরমার বর্ণনায় ছায়া স্নিগ্ধ অরণ্যের শ্যামকান্তি। কবি মধুসূদন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারা এই কাব্যে বিশেষভাবে প্রয়োগ করেছেন। একদিকে যেমন হোমার, ভার্জিল, টাসো, মিলটন প্রভৃতি, অন্যদিকে বাল্মিকী, ব্যাসদেব, কালিদাস, ভবভূতি প্রভৃতি ভারতীয় কবিগণ তাঁর কাব্যে ছায়া ফেলেছেন।
ব্রজাঙ্গনা কাব্য: কবি মধুসূদনের ‘প্রজাঙ্গনা’ কাব্য ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে রচিত ও প্রকাশিত হয়। ব্রজাঙ্গনা প্রকাশিত হলে পাঠক-পাঠিকার বিস্ময় আরো বেড়ে যায়। রাধা-কৃষ্ণ সংক্রান্ত কাহিনী অবলম্বনে ওড জাতীয় কাব্য রচনার পরিকল্পনা নিয়ে কবি মধুসূদন এই কাব্য রচনা করেছেন। এই কাব্যে বিরহ শোকাতুরা কৃষ্ণউন্মাদিনী ব্রজবধূ শ্রীরাধার মর্ম বেদনা ব্যাপ্ত হয়েছে প্রথম সর্গে বিরহ এবং দ্বিতীয় সর্গে রাধা কৃষ্ণের মিলনে কাব্যটি সমাপ্ত করার ইচ্ছে ছিল কবি মধুসূদনের। কিন্তু সময়ের অভাবে তিনি প্রথম সর্গে শ্রীরাধার শোকাহত চিত্তের কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন মাত্র দ্বিতীয় সর্গ লিখবার আর অবসর তিনি পাননি। কবি মধুসূদন বৈষ্ণব কবিদের মতো ভনিতা ব্যবহার করেছেন –
সহসা হইনু কালা জুড়ায় প্রাণের জ্বালা
আর কি পোড়া প্রাণ পাবে সে রতন।।
মধু যার মধুর ধ্বনি কহে, কেন কাঁদো ধনী
ভুলিতে কি পারে তোমা শ্রীমধুসূদন।।
বীরাঙ্গনা কাব্য: ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের বিষয়বস্তু অভিনব। অমিত্রাক্ষর ছন্দ, ভাষা, শব্দ যোজনা, অলংকরণ প্রভৃতি বিষয় বিশেষ চমকপ্রদ। অনেকে শ্রেষ্ঠ কবিতার কারুকর্ম হিসেবে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। গ্রিক কবি অভিদের ‘Heroides’ পত্র কাব্যের আদর্শকে কবি মধুসূদন ভারতীয় পৌরাণিক নারী ও বীরাঙ্গনা দের এক অভিনব চরিত্র চিত্রন উদঘাটিত করেন। ‘সোমের প্রতি তারা’, ‘পুরুরবার প্রতি ঊর্বশী’, ‘দশরথের প্রতি কেকয়ী’, ‘লক্ষ্মনের প্রতি সুর্পনখা’, ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ প্রভৃতি কাব্যাংশ অতি উৎকৃষ্ট।
চতুর্দশপদী কবিতাবলী: ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদনের শেষ কাব্য ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’। ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে ঋণগ্রস্ত কবি ‘সনেট’ জাতীয় কবিতা রচনা করেছিলেন। এই সনেটগুলি পেত্রার্ক ও শেক্সপীরীয় রীতি অবলম্বনে রচিত। বিদেশে দুঃখের দিনে তিনি এ সনেটগুলি রচনা করেন। তাই এতে তাঁর দেশের কথা, কপোতাক্ষ নদের কথা, দেব দেউলের কথা, ব্যাস-বাল্মিকী-কালিদাস-মুকুন্দরাম-ভারতচন্দ্র প্রভৃতির কথা জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
নাটক: বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটক দেখে মধুসূদন দত্ত বাংলা নাটকের দৈন্যদশা দেখে তিনি প্রথম পৌরাণিক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ রচনা করেন। মহাভারতের আদি পর্বের অন্তর্ভুক্ত শর্মিষ্ঠা-যযাতি~দেবযানীর কাহিনী থেকে নেওয়া হয়েছে এই নাটাকের বিষয়বস্ত। নানা ত্রুটি থাকলেও বাংলা নাটকের বিকাশ পর্বে এই নাটক স্মারক চিহ্ন হয়ে থাকবে।
সুন্দরী নারীর স্বাভাবিক ঈর্ষা নিয়ে রচিত ‘পদ্মাবতী’ নাটক। এই নাটকের কাহিনী গ্রিক পুরান থেকে গৃহীত, তবে ভারতীয় পরিবেশের আদলে তিনি এই কাহিনীকে সাজিয়েছেন।
জেমস টডের রাজস্থানের ইতিহাস অবলম্বনে মধুসূদনের ঐতিহাসিক নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ রচিত। এই নাটকের মধ্য দিয়ে মেবারের নির্বাপিতপ্রায় শেষ ম্লান রশ্মিটুকু মিলিয়ে যাওয়ার করুন কাহিনী ব্যক্ত হয়েছে ।
প্রহসন: মধুসূদনের বিচিত্র ধর্মী প্রতিভার উজ্জ্বল নিদর্শন হলো তাঁর দুটি প্রহসন – ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। নব্য ও শিক্ষিত বাবুদের ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপ, স্বাধীনতার নামে প্রগলভ আচরণ, উচ্ছৃঙখল ভোগাকাঙ্ক্ষা ও পানাশক্তি কিভাবে একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে অবক্ষয়কে ডেকে এনেছিল তারই বাস্তব নাট্যরূপ ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসন।
‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনটিতে প্রাচীন ধর্মর্ধ্বজী রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের ধ্বজাধারীদের শ্রেণীরূপকে উপস্থাপিত করেছেন। ভক্তপ্রসাদের মাধ্যমে প্রবীনদের মহাজনি কারবার, অর্থলোলুপতা ও কুমারী কুল কামিনীদের সর্বনাশ সাধন প্রভৃতি চিত্রিত হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, কবি মধুসূদন গীতিরসসিক্ত আরও কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা রচনা করেছেন এবং এই কবিতাগুলি সর্বপ্রথম আধুনিক লিরিক কবিতার মর্যাদা লাভ করেছে। ‘আত্মবিলাপ’ কবিতার কিছু অংশ এইরূপ –
‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়
তাই ভাবি মনে?
জীবন প্রবাহ বহি কাল সিন্ধু পানে ধায় ফিরাবো কেমনে?’
‘বঙ্গভূমি’ কবিতার কিছু অংশ:
‘রেখো মা দাসেরে মনে এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাধ ঘটে যদি পরমাদ
মধুহীন কোরনাগো তব মন কোকনদে।’
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন যুগন্ধরের কবি। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে নব-নবভাবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি একবার বন্ধুদের কাছে বলেছিলেন –
‘I can make and remake the Bengali language.’
কবির এই কথা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সর্বাংশে সত্য।
মহাকবির মহাপ্রয়াণ (২৯ জুন ১৮৭৩ খ্রি.) এর আগে জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূমির প্রতি তাঁর সুগভীর ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায়। তাঁর সমাধিস্থলে নিচের কবিতাটি লেখা রয়েছে :
“দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে”
Read More :