ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিতার উৎস, প্রেক্ষাপট ও সনেটের রীতি বিচার

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ কবিতার উৎস, প্রেক্ষাপট ও সনেটের রীতি বিচার  বিষয়ে এই পোস্টে আলোচনা করা হয়েছে।

Iswar Chandra Vidyasagar Kobitar Utsa, Prekshapat, Sonnet Riti Bichar

‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ হল একাদশ শ্রেণির বাংলা ক বিষয়ের একটি কবিতা। কবিতাটি লিখেছেন  মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিতার উৎস, প্রেক্ষাপট ও সনেটের রীতি বিচার – একাদশ শ্রেণি – বাংলা

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

👉 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিতার উৎস

বাংলা সনেট (চতুর্দশপদী) এর সার্থক স্রষ্টা কবি মধুসূদন দত্ত ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালেই ইতালির কবি পেত্রার্কের সনেট থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথম বাংলা সনেটের দিগন্ত উন্মোচন করেন। ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে কবি মধুসূদন দত্তের লেখা ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। সনেটকে বাংলায় চতুর্দশপদী নাম মহাকবি মাইকেল মধুসূদনই দিয়েছিলেন। পাঠ্য ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ কবিতাখানি মধুসূদনের চতুর্দশপদী কবিতাবলি গ্রন্থের অন্তর্গত। এটি কাব্যগ্রন্থের ৮৬ সংখ্যক কবিতা। যাতে মোট ১০০ টি কবিতা রয়েছে। তবে শশাঙ্কশেখর বাগচী সনাটের যে প্রামাণ্য সংস্করণ সম্পাদন করেছেন তার মধ্যে মধুসূদনের ১১০ টি সনেট আছে। এই কাব্যগ্রন্থের শুরু হয়েছে ‘বঙ্গভাষা’ এবং শেষ হয়েছে ‘সমাপ্তে’ কবিতা দিয়ে।

👉 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিতার প্রেক্ষাপট

কবি ভারত ত্যাগের পর আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে প্রথমে ইংল্যান্ডে যান কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া ও বর্ণবিদ্বেষের কারণে বেশি দিন সেখানে থাক না থাকতে পেরে ১৮৬০ সালে ফ্রান্সের ভাষায় নগরীতে চলে যান। তিনি সেখানে আর্থিক সংকটে পড়েন একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্য তাঁর আইন বিষয়ে পড়া শেষ করে ভারতে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

কবি বাংলা থেকে দূরে গিয়েই বাংলা ভাষাকে, কবতাক্ষ নদকে, দেব-দেউলকে আরো নিবিড়ভাবে ভালোবেসে ফেলেছেন। আর তার বহিঃপ্রকাশ তার ‘চতুর্দশ প্রতি কবিতাবলি’তে – যা মর্মপীড়িত বেদনার উচ্ছ্বাসে প্রতিকায়িত। তাই ভূদেব চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, – ‘‘চতুর্দশপদীর আধারে ‘কবতাক্ষ তীরের বটবৃক্ষের’ কথা নূতন করে স্মরণ করেছেন, তখন তাতে দূরগত স্বজনের প্রতি প্রবাসী মনের সকরুন মমতাবোধই কেবল উচ্ছ্বসিত হয়নি, ব্যর্থ-স্বপ্ন জীবনের নিভৃত দীর্ঘশ্বাসও যুক্ত হয়েছে তার সঙ্গে।’’ – (বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা) 

বিদেশে থেকে তার নিজের দেশের কথা কিভাবে কবিকে আকর্ষণ করত তার সেই ভাবের স্বরূপ সনেটগুলিকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। এজন্য মধুসূদনের সনেট একাধারে কবিতা ও কবির কবিচেতনার ইতিহাস। তাই সুকুমার সেন তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ – গ্রন্থে বলেছেন, –  ‘‘দেশের আকাশ-বাতাস-গন্ধ-স্পর্শের জন্য ব্যাকুল মধুসূদনের মনোবেদনার রেস চতুর্দশ পদাবলীর মধ্যে ঘনীভূত।’’

⭐ সনেট ⭐

👉 সনেট কী?:

ইংরেজ কবি কোলরিজ ‘সনেট’ বলতে বুঝিয়েছেন এমন এক ক্ষুদ্র কবিতা যাতে একটি অখন্ড ও সংহত ভাবকল্পনা বা অনুভূতির প্রকাশ ঘটে –

‘A small poem, in which some lonely feeling is developed.’

সমদৈর্ঘ্যের চোদ্দটি পংক্তিতে ও একটি বিশেষ ছন্দরীতিতে যখন কবিমনের একটি অখন্ড ভাবকল্পনা কাব্যরূপ লাভ করে তখন আমরা তাকে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা বলে চিহ্নিত করি। আমাদের আলোচিত ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ কবিতাটিও একটি সনেট ধর্মী কবিতা।

👉 সনেটের উৎপত্তি 

ইতালীয় শব্দ Sonetto থেকে Sonnet শব্দের উৎপত্তি। Sonetto-এর অর্থ ছোট শব্দ বা গান। জিয়াকোমো ডা লেন্টিনি সনেটের উদ্গাতা বলে মনে করেন কেউ কেউ। তবে ইটালিয়ান কবি পিয়ারো ভিন সর্বপ্রথম সনেটের প্রবর্তন করেন। সিসিলীয় কবি গুইত্তোন সর্বপ্রথম সনেট-এর নিয়ম কানুনের বাঁধনটি দেখান। ত্রয়োদশ শতকে ইটালিয়ান কবি পিয়ারো ভিনের রচনায় প্রথম সার্থক সনেট-এর ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু সনেট বলতে আমরা যা বুঝি তার যথার্থ জনক হলেন কবি পেত্রার্ক। 

👉 সনেটের বৈশিষ্ট্য 

  • ১. এ কবিতায় থাকবে চোদ্দটি পংক্তি এবং প্রতি পংক্তিতে চোদ্দ অক্ষর বা মাত্রা। তবে কখনো কখনো চোদ্দ পংক্তির কম বা বেশি পংক্তিতে এবং প্রতি পংক্তিতে আঠারো বা আরো বেশি সংখ্যক মাত্রায় সনেট লেখা হয়েছে।
  • ২. সাধারণভাবে অষ্টক ও ষট্ক, এই দুই অংশে বিভক্ত থাকবে। এই পেত্রার্কীয় ধ্রুপদী রীতির বিকল্প হিসেবে তিনটি চতুষ্ক ও একটি দ্বিপদিকা দিয়ে সনেট লেখা হয় শেক্‌স্পীরীয় রীতিতে। এছাড়াও অবয়ব ও মিলবিন্যাস রীতির কিছু রকমফের হয়ে থাকে।
  • ৩. সংহত ও মিতায়তন এই রচনায় একটি মাত্র ভাবের দ্যোতনা লক্ষ করা যায়।
  • 8. ভাবের সংযম ও গভীরতা এবং ভাষার ঋজুতা ও পরিমিতি সনেটের আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য।
  • ৫. নির্মাণরীতির বিশিষ্টতার কারণে গীতিকবিতার অপরাপর রূপের মতো স্বতঃস্ফূর্ততা বা উচ্ছ্বাস সনেটে থাকে না।

👉 সনেটের শ্রেণিবিভাগ 

আধুনিক সনেট প্রধানত তিন প্রকার। যথা – 

  • ১) পেত্রার্কীয় সনেট
  • ২) শেক্সপিরীয় সনেট
  • ৩) ফরাসি রীতির সনেট

১) পেত্রার্কীয় সনেট: পেত্রার্কের সনেটের মিলবিন্যাসরীতি অনুযায়ী অষ্টক-এ দুটি চতুষ্ক থাকে – ক খ খ ক, ক খ খ ক; ষটক – গ ঘ গ ঘ গ ঘ। 

পেত্রার্কীয় রীতির নমুনা রূপে মধুসূদন দত্তের ‘শ্মশান’ সনেটটি উদ্ধার করা যাক: 

বড় ভালোবাসি আমি ভ্রমিতে এ স্থলে, ক

তত্ত্ব-দীক্ষা-দায়ী স্থল জ্ঞানের নয়নে। খ

নীরবে আসীন হেথা দেখি ভস্মাসনে খ

মৃত্যু-তেজহীন আঁখি, হাড়-মালা গলে, ক

বিকট অধরে হাসি, যেন ঠাট-ছলে! ক

অর্থের গৌরব বৃথা হেথা-এ-সদনে খ

রূপের প্রফুল্ল ফুল শুষ্ক হুতাশনে, খ

বিদ্যা, বুদ্ধি, বল, মান, বিফল সকলে। ক

কি সুন্দর অট্টালিকা, কি কুটীর-বাসী, গ

কি রাজা, কি প্রজা, হেথা উভয়ের গতি। ঘ

জীবনের স্রোতঃ পড়ে সাগরে আসি। গ

গহন কাননে বায়ু উড়ায় যেমতি ঘ

পত্র-পুঞ্জে, আয়ু-কুঞ্জে কাল, জীব-রাশি গ

উড়ায়, এ নদ-পাড়ে তাড়ায় তেমতি। ঘ

২) শেক্সপিরীয় সনেট: চতুর্দশ পঙ্ক্তিতে রচিত শেক্সপিয়রের সনেট পেত্রার্কা-এর ন্যায় অষ্টক ও ষষ্টকে বিভক্ত নয়। যদিও ষষ্টকে প্রায়ই ভাবের বিরাম দেখা যায়। এর প্রথম দ্বাদশ পক্তিতে থাকে তিনটি চতুষ্ক (৪ × ৩ = ১২)। মিল বা মিত্রাক্ষর সংস্থান এক পদান্তর পর্যায়ে বিন্যস্ত। – শেষ দুই পদে মিত্রাক্ষর পয়ার শেক্সপিরীয় সনেটের বিশেষত্ব। ফলে মিল বিন্যাস দাঁড়ায়-ক-খ-ক-খ : গ-ঘ-গ-ঘ; ঙ-চ-ঙ-চ ; ছ-ছ। এখানেই শেক্সপিয়রের অবলম্বিত রীতির আঙ্গিকগত স্বকীয়তা।

শেক্সপিরীয় সনেটের রীতির নমুনা রূপে দেবেন্দ্রনাথ সেনের ‘অশোকগুচ্ছ’ সনেটটি উদ্ধার করা যাক: 

হে অশোক, কোন্ রাঙ্গা-চরণ-চুম্বনে ক

মর্মে মর্মে শিহরিয়া হ’লি লালে-লাল? খ

কোন্ দোল-পূর্ণিমায় নব-বৃন্দাবনে ক

সহর্ষে মাখিলি ফাগ্, প্রকৃতি-দুলাল? খ

কোন্ চির-সধবার ব্রত-উদযাপনে গ

পাইলি বাসন্তী শাড়ী সিন্দূর-বরণ? ঘ

কোন্ বিবাহের রাত্রে বাসর-ভবনে গ

একরাশি ব্রীড়া হাসি করিলি চয়ন? ঘ

বৃথা চেষ্টা-হায়! এই অবনী মাঝারে। ঙ

কেহ নহে জাতিস্মর—তরু-জীব-প্রাণী! চ

পরাণে লাগিয়া ধাঁধাঁ আলোক-আঁধারে, ঙ

তরুও গিয়াছে ভুলে অশোক-কাহিনী! চ

শৈশবের আবছায়ে শিশুর ‘দেয়ালা’, ছ

তেমতি, অশোক, তোর লালে-লাল খেলা! ছ

৩) ফরাসি রীতির সনেট: ফরাসি রীতির সনেটে প্রথমে স্তবকে দুইটি চতুষ্ক এরপর একটি সমিল দ্বিপদীকা এবং পরে একটি চতুষ্ক লক্ষ্য করা যায় অথবা কখনো শেষে দুইটি ত্রিপদীকাও লক্ষ্য করা যায়।

চারটি স্তবক যথাক্রমে ৪+৪+২+৪ অথবা ৪+৪+৩+৩ চরন নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে আর ভাবের অবতারনা ও পরিণতির বিষয়ে এখানে অতটা দৃঢ় ব্যাকরণের নজর পাওয়া যায় না।

ফরাসি রীতির সনেট নমুনা রূপে প্রথম চৌধুরীর ‘অন্বেষণ‘ কবিতাটি উদ্ধার করা যাক:

আজিও জানিনে আমি হেথায় কি চাই! ক

কখনো রূপেতে খুঁজি নয়ন উৎসব, খ

পিপাসা মিটাতে চাই ফুলের আসব, খ

কভু বসি যোগাসনে, অঙ্গে মেখে ছাই।। ক

কখনো বিজ্ঞানে করি প্রকৃতি যাচাই, ক 

খুঁজি তারে যার গর্ভে জগৎ প্রসব, খ 

পূজা করি নির্বিচারে শিব কি কেশব, খ

আজিও জানিনে আমি তাহে কিবা পাই।। ক

রূপের মাঝারে চাহি অরূপ দর্শন। গ 

অঙ্গের মাঝারে মাগি অনঙ্গস্পর্শন।। গ

খোঁজা জানি নষ্ট করা সময় বৃথায়, ঘ 

দূর তবে কাছে আসে, কাছে যবে দূর। ঙ

বিশ্রাম পায় না মন পরের কথায়, ঘ

অবিশ্রান্ত খুঁজি তাই অনাহত-সুর।। ঙ

👉 সনেট রীতি বিচার 

বাংলা কবিতা এই পেত্রার্কীয় ও শেক্সপিরীয় উভয় রীতিতেই সার্থক সনেট রচনা করেছিলেন মধুসূদন। অনেক সময় মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন দুই রীতির। তবে তাঁর রচিত ‘বিদ্যাসাগর’ কবিতাখানি পেত্রার্কীয় রীতিতে রচিত। নিচে মধুসূদন দত্তের ‘বিদ্যাসাগর’ কবিতার সনেটের রীতি বিচার করা হলো:

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে। ক

করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে, খ

দীন যে, দীনের বন্ধু !– উজ্জল জগতে ক

হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে। খ

কিন্তু ভাগ্য-বলে পেয়ে সে মহা পর্বতে, ক

যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে, খ

সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে ক

গিরীশ। কি সেবা তার সে সুখ সদনে ! খ

দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী। গ

যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে ঘ

দীর্ঘ-শিরঃ তরু-দল, দাসরূপ ধরি। গ

পরিমলে ফুল-কুল দশ দিশ ভরে, ঘ

দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী, গ

নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে। ঘ

আরও আপডেট পেতে আমাদের সঙ্গী হও

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *