নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রবন্ধ রচনা (Nirendranath Chakraborty rochona in bengali), নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এর জীবনী (Nirendranath Chakraborty Biography in Bengali) , শতবর্ষের আলোকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী উচ্চ মাধ্যমিক 2025 রচনা (HS 2025), উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা রচনা
শতবর্ষের আলোকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী – প্রবন্ধ রচনা | Nirendranath Chakraborty rochona in bengali
প্রদত্ত সূত্র ও তথ্য অবলম্বনে একটি প্রবন্ধ রচনা করো :
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
জন্ম: বাংলাদেশের ফরিদপুরে, ১৯ অক্টোবর ১৯২৪ সালে।
পিতা-মাতা: জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মা ছিলেন প্রফুল্লনলিনী দেবী।
শিক্ষা জীবন: প্রাথমিক শিক্ষা ফরিদপুরের পাঠশালায়। পরে বঙ্গবাসী স্কুল, মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আইএ পাশ। সেন্ট পলস কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।
সাহিত্য জীবন: ‘সত্যযুগ’ পত্রিকার সাংবাদিক। ১৯৫১ সালে ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার সাংবাদিক। ‘নীল নির্জন’, ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নীরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’।
বিখ্যাত কাব্য: মুকুন্দপুরের মনসা’, ‘লকারের চাবি’, ‘আংটি রহস্য’ ‘গোয়েন্দা গল্প।’ ‘নীরবিন্দু’ আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস।
পুরস্কার ও সম্মাননা : ১৯৭৪-এ সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। ১৯৫৮-এ ‘উল্টোরথ পুরস্কার’ ১৯৭০-এ ‘তারাশঙ্কর স্মৃতি পুরস্কার’, ১৯৭৬-এ ‘আনন্দ শিরোমণি’ পুরস্কার, ২০০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট উপাধি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘বঙ্গবিভূষণ’ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেন।
মৃত্যু: ২০১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর, ৯৪ বছর বয়সে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভূমিকা
‘যে জানালা আজও বন্ধ আমার,
এবারে তা যেন খুলতে পারি।
যে রয়েছে শুয়ে ধূলিসয্যায়
যেন হাতে ধরে তুলতে পারি।
পিছনে যা আছে পিছনেই থাক্
যেন পিছু ডাক ভুলতে পারি।’
রবীন্দ্রনাথের মতো প্রবল আশাবাদ নিয়ে পঞ্চাশের দশকের মননশীল আধুনিক কবি সমকালীন জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে। কবি চিত্তের অনন্ত প্রশান্তি ও তাঁর আন্তরিকতায় কবিতাগুলি অনন্যত লাভ করেছে। তাঁর কবিতাগুলি যেন আর্টিস্টের আঁকা ছবি। সেই ছবি বাস্তব জীবনের এবং সমকালীন সময়ের। তাই তা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে।
জন্ম ও পিতৃপরিচয়
পিতা জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মাতা প্রফুল্লনলিনীর কোল আলো করে ১৯২৪ সালের ১৯ শে অক্টোবর বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরের চান্দ্রায় কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জন্ম।
শিক্ষা জীবন
ফরিদপুরের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ স্কুল থেকে ১৯৪০ -এ তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৪২-এ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে তিনি আই. এ. পাস করেন। ১৯৪৪ -এ সেন্টপলস্ কলেজ থেকে ইতিহাস নিয়ে স্নাতক হন।
সাহিত্যের আঙিনায় কবি
১৯৪২ থেকেই তিনি মাতৃভূমি, প্রত্যহ, ভারত, স্বরাজ পত্রিকা, সত্যযুগ, শ্রীহর্ষ, কিশোর পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫১ থেকে আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঐ পত্রিকার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ কাব্য সংকলনগুলি হলো –
- ১) নীল নির্জন – ১৯৫৪ খ্রী.
- ২) অন্ধকার বারান্দা – ১৯৬১ খ্রী.
- ৩) নীরক্ত করবী – ১৯৬৫ খ্রী.
- ৪) নক্ষত্র জয়ের জন্য – ১৯৬৯ খ্রী.
- ৫) কলকাতার যীশু – ১৯৬৯ খ্রী.
- ৬) উলঙ্গ রাজা – ১৯৭১ খ্রী.
- ৭) খোলা মুঠি – ১৯৭৪ খ্রী.
- ৮) কবিতার বদলে কবিতা – ১৯৭৬ খ্রী.
- ৯) আজ সকালে – ১৯৭৮ খ্রী.
- ১০) পাগলা ঘন্টি – ১৯৮১ খ্রী.
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একাধিক গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রের নাম ভাদুড়ী মশাই। উপন্যাস ‘নীরবিন্দু’ আত্মজীবনীমূলক। তাঁর রচিত ভ্রমণ কাহিনি ‘গঙ্গাযমুনা’।
কবি কলমে সমাজ
আত্মসর্বস্ব আধুনিক সভ্যতার নির্লজ্জ রূপ দেখে ব্যথিত কবি তাঁর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় রূপকের ছলে প্রশ্ন করেছেন শাসকশক্তির কাছে –
‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’’
কবির ‘হ্যালো দমদম’ কবিতাটিতে বৃষ্টি জলে প্লাবিত শহরের রাস্তায় বন্দী মানুষের অসহায় আর্তনাদ ধ্বনিত হয়েছে, যে আর্তনাদ কেউ গ্রাহ্য করছে না। আবার আমরা কবির ‘না রাম না গঙ্গা’ কবিতায় দেখি নেতাদের ভোট কেন্দ্রিক সুবিধাবাদী তার নির্লজ্জতার বহিঃপ্রকাশ। যেখানে নেতারা মানুষকে দেখেন ভোটের নিরিখে। আর এইসব অপ্রিয় সত্যটি কবি উপস্থাপিত করেছেন এই কবিতায়।
মানুষ-ঈশ্বর-জীবন-ভালবাসা
মানবতার পূজারী নীরেন্দ্রনাথ মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজেছেন, মানুষের সাড়ুলের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশকে উপলব্ধি করেছেন কবি। তাঁর ‘কলকাতার যীশু’ কবিতায় কবি দেখিয়েছেন কৃত্রিম এই শহরে সভ্যতায় শিশুটি যেন এক মুঠো আনন্দ-নির্মল হাওয়া –
‘রাস্তায় এক-পার থেকে অন্য-পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।’
মানবতাকে উপস্থাপিত করতে গিয়ে কবি জীবনকে ভালোবেসেছেন – গভীর মমত্ববোধ দিয়ে। তাই কবি ‘স্বপ্নে দেখা ঘর দুয়ার’ কবিতায় বলেছেন –
‘ও বড়ো বউ, ডাকো ওকে ডাকো
এই যে লোকটা পার হয়ে যায়
কাঁসাই নদীর সাঁকো।’
তাঁর কবিতা লেখার প্রেরণাও মানুষ, তাই মানুষ ও কবিতা তাঁর কাছে সমার্থক। তাই ‘কবিতা কল্পনালতা’ কবিতায় লিখেছেন –
‘স্পষ্ট কথাটাকে আজ অন্তত একবার স্পষ্ট করে বলে দেওয়া ভাল।’
কবি তাঁর ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’ – কবিতায় জীবনযুদ্ধে পরাজিত সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন –
‘সেই অমলকান্তি-রোদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে
ভাবতে ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।’
কবি ও প্রকৃতি
মানুষের কাছে মানুষের জন্য প্রেম ও ভালোবাসার প্রত্যাশায় প্রত্যাখ্যানের অসহায়তা কবিকে নিয়ে যায় প্রাকৃতিক জগতে – যেখানে কবি জীবনের নির্মল আনন্দ খুঁজে পান –
‘আকাশে গৈরিক আলো। হেমন্ত দিনের মৃদু হাওয়া
কৌতুকে আঙ্গুল রাখে ঘরের কপাটে,
জানালায়। —- (হলুদ আলোর কবিতা)
সম্মাননা ও স্বর্গারোহণ
কবি ‘উলঙ্গ রাজা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৭৪ সালে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পান। পেয়েছেন উল্টোরথ পুরস্কার, ১৯৭০ সালে তারাশঙ্কর স্মৃতি ও ১৯৭৬ সালে আনন্দ শিরোমনি পুরস্কার পান কবি। ২০০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ডি. লিট. উপাধি ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে বঙ্গবিভূষণ সম্মানে সম্মানিত করেছে।
দীর্ঘ রোগভোগের পর ৯৪ বছর বয়সে ২০১৮ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন কবি।
উপসংহার
কবির জন্মশতবার্ষিকীতে কবিতায় ‘একলা বকুল’ -এর সুবাস নিতে নিতে দুই চোখ বড্ড বেশি করে, স্তাবকতার ঠুলি পরে শাবাস দেওয়া মানুষের ভিড়ে সেই শিশুকে খুঁজে ফেরে যে লোভী, নির্লজ্জ শাসকশক্তির কাছে নির্ভয়ে গলা তুলে বলবে – ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখতে হয় ভিখারি মায়ের নিরন্ন, নগ্ন শিশু ‘কলকাতার যীশু’কে – যা শাসন যন্ত্রের অপদার্থতাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তাই নীরেন্দ্রনাথ না থেকেও শতবর্ষ, শতবর্ষ পেরিয়েও শত-শত বর্ষ প্রাসঙ্গিক।
Read More :